৬১০ খ্রিস্টাব্দে মহাবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রাপ্ত হন। তিনি যখন মক্কার হেরা গুহায় ইবাদত করছিলেন, তখন জিব্রাইল আ : তার কাছে প্রথম অহী নিয়ে আসেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পর ৬১০ থেকে ৬১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি গোপনে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কিন্তু আসল ঘটনা শুরু হয় যখন তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ৬১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন । ফলে মক্কার কুরাইশরা মহানবী ও যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের উপরে নির্যাতন শুরু করে । পরবর্তীতে তারা মদিনায় হিজরত করেন, এরপর তখন কুরাইশদের আক্রমণ আরো বাড়তে থাকে। এদিকে মুসলমানরা আবার চুপ করে বসে থাকে না এর ফলে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় যার নাম বদরের যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ ইতিহাস নির্ধারক যুদ্ধ নামে পরিচিত।
ঘটনা:
মদিনায় হিজরতের আগে মক্কার নেতৃস্থানীয়দের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল মুসলমানদের। তবে, পরবর্তীতে মক্কা ও মদিনার মধ্যে যুদ্ধের নেপথ্যে এটাই একমাত্র কারণ নয়।
দ্বিতীয় হিজরি বর্ষের রজব মাসের ১১ তারিখে মক্কার একজন গোত্র প্রধান আমর বিন আল-হাদরামি দুর্ঘটনাবশত মুসলমানদের হাতে নিহত হন। ইসলামের নবী স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে এই হত্যার জন্য ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেন। কিন্তু মক্কায় কুরাইশদের প্রধানরা এই ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। ইবনে খালদুন লিখেছেন, আমর ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুতেই বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সূচিত হয়।
শা‘বান মাসে ঘটে আরেকটি ঘটনা:
কুরাইশদের সম্পদ বোঝাই একটি কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কায় আসছিল। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মুসলমানরা তাদেরকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। আবু সুফিয়ান ছিলেন কাফেলার নেতা। তিনি সহায়তার জন্য মক্কায় দূত মারফত খবর পাঠান। বার্তা পেয়ে মক্কা থেকে কুরাইশদের একটি দল আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে সাহায্য করার জন্য মদিনার উদ্দেশে রওনা হয়।
মা’আরিফ ইসলামির অনুসারে, সিরিয়া থেকে আগত কাফেলা মক্কায় পৌঁছে গিয়েছিল ঠিকই। অর্থাৎ, কুরাইশদের উচিত ছিল মদিনার দিকে যাওয়া কাফেলাকে ফেরত আনা। কিন্তু, আবু জাহলের পীড়াপীড়িতে তারা মদিনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৬ই রমজান তারা বদর নামক স্থানটিতে শিবির স্থাপন করে। বলা হয়ে থাকে, এই পক্ষে লোক সংখ্যা ছিল নয়শো থেকে এক হাজার। তারা সবাই ছিল সশস্ত্র।
সংবাদ পেয়ে ১২ই রমজান ইসলামের নবীও বদরের উদ্দেশে অগ্রসর হন। ১৭ই রমজান ৩১৩ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি ময়দানের কাছাকাছি পৌঁছান। খ্রিস্টাব্দে নিরিখে তারিখটা ৬২৪ সালের ১৩ই মার্চ। তখন পর্যন্তও কুরাইশদের মধ্যে শান্তিপ্রিয় কিছু ব্যক্তি যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু, আবু জাহেলের একগুঁয়েমির কারণে তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ফলে, যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।
যুদ্ধের শুরু ও শেষ:
যুদ্ধকৌশল অনুযায়ী মুসলমানদের সেনাদের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। জুবায়ের বিন আল-আওয়ামকে একটি দলের অধিনায়ক মনোনীত করা হয়। কুদ বিন আমরকে নির্দেশ দেয়া হয় মাসরায় অবস্থান নিতে। মূল নেতৃত্বে ছিলেন নবী স্বয়ং। বাহিনীর পেছনের অংশে থাকা কমান্ড অব সাকাহ’র দায়িত্ব কায়েস ইবনে সা’সা-এর ওপর ন্যস্ত করা হয়। যোদ্ধা দলটির সবচেয়ে বড় প্রতীক নিশানটি বহন করছিলেন মুসআব বিন উমাইর। মুসলমানদের পরিচয় ছিল ‘ইয়া মনসুর উম্মাহ’।
আরব ঐতিহ্য মেনে, একক লড়াইয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের শুরু হয়। এতে তিনজন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হন। তারপরে শুরু হয় মল্লযুদ্ধ। যুদ্ধে, দুই তরুণ আনসার(যোদ্ধাদের সহায়তাকারী) মু’য়াওজ এবং মু’য়াজ মক্কার আবু জাহলকেও হত্যা করে। এতে, মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধের পাল্লা ভারী হতে শুরু করে।
কুরাইশরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল ঠিকই, তারপরও মল্লযুদ্ধের পর নবী মোহাম্মদের নির্দেশে মুসলমান যোদ্ধারা অতর্কিত কুরাইশদের উপর আক্রমণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণ যুদ্ধের চেহারা পাল্টে দেয়। আর কুরাইশ বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধে ৭০ জন গুরুত্বপূর্ণ কুরাইশ নেতা মারা পড়েন। ৭০ জনকে আটক করা হয়।
সিদ্ধান্ত হয়, চার হাজার চারশো দিরহাম মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয়া হবে। আর, যারা লেখাপড়া জানতেন তারা দশ জন আনসারের সন্তানকে লিখতে ও পড়তে শেখাবেন।
গুরুত্ব:
এই যুদ্ধ ছিল নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত সে কারণেই এটিকে বিশ্বের কয়েকটি ‘নির্ধারক যুদ্ধের’ অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও সংখ্যাগত দিক থেকে এটি বড় কোন যুদ্ধ নয়। কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলামের অনুসারে, এই যুদ্ধের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দুই ধরনের প্রভাবই ছিল। বইটি থেকে জানা যায়, মক্কার যেসব গুরুত্বপূর্ণ নেতা মারা যান, তাদের ছিল দৃঢ় প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক দক্ষতা।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও মক্কার যোদ্ধাদের পরাজয়ের ফলে একদিকে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং মর্যাদাহানি হয়। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের পরে বদরের ওই বাণিজ্য পথ ব্যবহারের ঝুঁকিও হ্রাস পায়। মক্কার অর্থনীতি এই পথে পরিচালিত ব্যবসার উপর নির্ভরশীল ছিল, কেমব্রিজ’র হিস্ট্রি অব ইসলাম থেকে এমন তথ্যই মিলছে।
অর্থাৎ, কুরাইশদের দিক থেকে দেখলে, সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সিরিয়ায় তাদের বাণিজ্যের পথও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। ফলে, অন্যান্য গোত্রের কাছে তাদের গুরুত্ব কমে যায়। এই যুদ্ধে মক্কাবাসীরাই সর্বক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঠিকই। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে দাঁড়ায় সম্মান ও মর্যাদাহানি। আরব অঞ্চলে কুরাইশদের মক্কার একটি বিশিষ্ট অবস্থান ছিল। একে অনেকটা আরবের রক্ষাকর্তার মতো বিবেচনা করা হতো।
কিন্তু একটি ছোট দলের হাতে সেই মক্কাবাসীদের পরাজয় আরবদের একটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যায়। হাদিস অনুসারে, সমগ্র অঞ্চলে এই পরাজয়ে কথা রটে যায়। অসম্মানের গ্লানি এড়াতে মক্কার লোকেরা কোনোরকম উচ্চবাচ্য ছাড়া নীরবে শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বলে দেয়া হয়, কেউ যেন কোনো কবিতায়ও নিহতদের স্মরণ না করে।
এই নীরব শোকের পাশাপাশি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার তাড়নাও ছিল তাদের। কেমব্রিজের তথ্যমতে, অন্যপক্ষে, বদরের যুদ্ধ মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।


