চিয়া সিড কী?
বর্তমান সময়ে মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ সচেতন। বিশেষ করে করোনাকালীন জটিলতার পর থেকেই সাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রতিদিনের খাবার ও খাবারের পুষ্টিগুণ নিয়ে মানুষের সচেতনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। স্বাস্থ্য নিয়ে যারা সচেতন আছেন এসব মানুষের খাবারের তালিকায় এখন অনেকটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে সুপার ফুড নামে খ্যাত “চিয়া সিড”।
চিয়া সিড দেখতে ছোট, কালো বা হাল্কা সাদা রঙের একটি ছোট বীজ যা সলভিয়া হিস্পানিকা নামক একটি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়। এই উদ্ভিদটি মূলত মেক্সিকো ও গুয়াতেমালা অঞ্চলে পাওয়া যায়। চিয়া সিড বিখ্যাত তার পুষ্টিগুণের জন্য এবং এটি বহু বছর ধরে মায়া এবং আজটেক সভ্যতার মধ্যে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি একটি “সুপারফুড” হিসেবে পরিচিত, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ রয়েছে।
চিয়া সিডে থাকা পুষ্টিকর উপাদান:
চিয়া সিডে রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টিকর উপাদান, যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করে। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তুলে ধরা হলো:
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: চিয়া সিডে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যালফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (ALA), যেটি একটি প্রাকৃতিক ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। এটি হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভাল রাখে, প্রদাহ কমায় এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- প্রোটিন: চিয়া সিডে প্রচুর গুণগত প্রোটিন রয়েছে। যা শরীরের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে অনেকগুণ।
- ফাইবার: চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার (প্রায় ৩৪%) থাকে। এটি হজমে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- ক্যালসিয়াম: চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড়কে শক্তিশালী করে এবং হাড়ের ভঙ্গুরতা রোধ করতে সাহায্য করে। চিয়া সিড খাওয়ার মাধ্যমে দেহে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করা যায় অনেকটাই, বিশেষ করে যারা দুগ্ধজাতীয় জিনিস খেতে পারেন না তাদের জন্য চিয়া সিড অনেক উপকারি।
- এন্টি-অক্সিডেন্ট: চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যেমন পলিফেনলস, যা শরীরকে ক্ষতিকর র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে এবং কোষকে ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি শরীরের প্রদাহ কমাতে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
- ভিটামিন এবং মিনারেলস: চিয়া সিডে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং মিনারেলস রয়েছে, যেমন:
- ভিটামিন B (B1, B2, B3, B6)
- ম্যাগনেসিয়াম
- আয়রন
- ফসফরাস
- জিঙ্ক
- পটাসিয়াম
চিয়া সিডের উপকারিতা ও গুণাগুণ:
- ওজন কমাতে সাহায্য: চিয়া সিডে থাকা ফাইবার ও প্রোটিন সারা দিন ধরে পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে, যার ফলে এটি খেলে খিদে কম হয় এবং খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এতে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ কমে যায়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য: চিয়া সিডে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর।
- হজমের প্রক্রিয়া বৃদ্ধি: চিয়া সিডে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এটি দ্রুত খাবার হজম করে।
- রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ: চিয়া সিডে থাকা উচ্চ মাত্রার ফাইবার রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্যও এটি অত্যন্ত উপকারী।
- ত্বক সুরক্ষা: চিয়া সিডে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বকের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, ত্বককে আর্দ্র রাখে এবং বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে।
- হাড়ের ক্ষয়রোধ: চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম থাকায় এটি হাড়ের ক্ষয়রোধ, হাড়ের সাস্থ্য ভাল এবং অস্টিওপোরোসিস রোধে সাহায্য করে।
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম:
চিয়া সিডকে বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। যেমন সকালে খালি পেটে, সরবত বানিয়ে বা সালাদের সাথেও খাওয়া যায়। চিয়া সিড খাওয়ার আরো কিছু কার্যকরি নিয়ম দেখা যাক:
- ভিজিয়ে খাওয়া: চিয়া সিড একবারে শুকনো খাওয়ার চেয়ে ভিজিয়ে খাওয়া বেশি উপকারি। এক চামচ চিয়া সিড এক গ্লাস পানির সাথে ভিজিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে দিলে সিডগুলো ফুলে উঠে একধরনের জেলি-জাতীয় আকার ধারণ করে। বেশি উপকার পাওয়ার জন্য সকালে খালি পেটে খাওয়া উত্তম।
- স্মুদি বা জুসে মিশিয়ে: পরিমাণ অনুযায়ী চিয়া সিড আপনি আপনার পছন্দ অনুযায়ী স্মুদি বা ফলের জুসে মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে পুষ্টির পরিমাণ আরো বাড়বে এবং খাবার আরো মজাদার হবে।
- পুডিং তৈরি করা: পরিমাণ মত চিয়া সিড দিয়ে পুডিংও তৈরি করা যায়। এক কাপ কোকোনাট মিল্ক বা দুধের সাথে এক চামচ চিয়া সিড মিশিয়ে কিছু সময় রেখে দিলে এটি পুডিংয়ের মতো হয়ে যাবে, যা একটি স্বাস্থ্যকর নাস্তায় পরিণত হয়ে যাবে।
- শস্যের মিশ্রণ: চিয়া সিড পোরিজ, সিরিয়াল বা ওটমিলের মধ্যে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে। এতে সিডের পুষ্টি উপাদান সঠিকভাবে শোষিত হয়।
- বেকড পণ্য: চিয়া সিড বেকিং রেসিপিতেও ব্যবহার করা যায়। কেক, মাফিন বা প্যানকেকের মধ্যে মিশিয়ে তৈরি করা যায়, যা খাবারের পুষ্টিগুণ বাড়ায়।
বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ সৈয়দা শিরিনা স্মৃতির মতে, চিয়া সিড খাওয়ার উপকারিতা
- চিয়া সিডে আছে ওমেগা-৩, যা হৃদরোগের ঝুঁকি ও ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে
- এটি শরীরের শক্তি বৃদ্ধি ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়
- চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় চিয়া সিড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে
- মেটাবলিক সিস্টেমকে উন্নত করার মাধ্যমে এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে
- চিয়া সিড ব্লাড সুগার স্বাভাবিক রাখে, যা ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায় অনেকাংশেই
- এতে আছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, যা হাড় গঠন ও হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ উপকারী
- চিয়া সিড কোলন পরিষ্কার রাখে, যার ফলে কোলন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কমে
- চিয়া সিড শরীর থেকে টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) বের করে দিতে সাহায্য করে
- এটি পেটের প্রদাহজনিত বা গ্যাসের সমস্যা দূর করে দেয়
- চিয়া সিড ভালো ঘুম হতেও সাহায্য করে
- চিয়া সিড ক্যানসার রোধ করে
- হজমে সহায়তা করে
- হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা দূর করে
- সিয়া সিড ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর রাখে
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম বিষয়ে পুষ্টিবিদ সৈয়দা শিরিনা স্মৃতি বলেন, দ্রুত ওজন কমাতে সকালে খালি পেটে ও রাতে ঘুমানোর আগে ১ গ্লাস পানির মধ্যে ২ চা চামচ চিয়া সিড ও ২ চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। খাওয়ার ২৫/৩০ মিনিট আগে পানিতে সাধারণ তাপমাত্রায় চিয়া সিড ভিজিয়ে রাখতে হবে। তবে, যেহেতু চিয়া সিডের নিজস্ব কোনো স্বাদ নেই, তাই এটি যে কোনো শরবত, স্মুদি, কাস্টার্ড, টকদই বা অন্যান্য যেকোন খাবারের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যায়।
সতর্কতা:
- অতিরিক্ত পানি পান করা: চিয়া সিডের মধ্যে পানি শোষণের ক্ষমতা রয়েছে অনেক। অতিরিক্ত চিয়া সিড খেলে বেশি পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন হয়, যাতে শরীরের পানিশূন্যতা না হয়।
- অ্যালার্জি: যাদের এলার্জি রয়েছে তারা সি সুপার ফুড খাওয়া হতে বিরত থাকবেন, কেননা চিয়া সিড এলার্জি বাড়িয়ে দিতে পারে।
- গ্যাস্ট্রিক সমস্যা: যাদের গ্যাস্ট্রিক বা বদহজমের সমস্যা আছে, তারা চিয়া সিড পরিমাণ মত এবং সাবধানে খাবেন।


