সজনে পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা

সজনে পাতা (Moringa leaves) আমাদের দেশে জনপ্রিয় অত্যন্ত পুষ্টিকর ও উপকারী একটি সবজি, যা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসা এবং পুষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সজনে গাছকে “ড্রামস্টিক ট্রি” বা “লেজেন্ডারি প্ল্যান্ট” হিসেবেও অভিহিত করা হয়, কারণ এটি মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারি। সজনে গাছের পাতা, ফুল, বীজ, এবং শেকড় সবই বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতায় ভরপুর। তবে, সজনে পাতার উপকারিতা সবচেয়ে বেশি।গবেষকরা সজনে পাতাকে সুপার ফুড বলে থাকে। নিচে সজনে পাতার প্রধান কিছু উপকারিতা ও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

১. পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ

সজনে পাতার মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণে খনিজ, ভিটামিন, প্রোটিন, ভিটামিন A, C, E, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম। এক গ্লাস সজনে পাতার রস আপনার দৈনিক পুষ্টির চাহিদার অনেকটাই পূর্ণ করতে সক্ষম। বিশেষ করে, এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C রয়েছে, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২. এন্টিঅক্সিডেন্ট গুণ

সজনে পাতায় অনেক শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে, যেমন: ভিটামিন C, ক্যাটেচিন, এবং কোয়ারসিটিন। এই উপাদানগুলো শরীরের কোষগুলিকে ফ্রি রেডির্ক্যালস থেকে রক্ষা করে, যা কোষের ক্ষতি ও বার্ধক্য রোধে অত্যন্ত উপকারি। এই এন্টিঅক্সিডেন্টগুলো আমাদের ত্বক এবং শরীরের সেলুলার স্বাস্থ্য রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে শরীরের ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায় এবং রোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

৩. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ

সজনে পাতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, যা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সজনে পাতা ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং স্বাভাবিক রক্তচাপ বজায় রাখে।

৪. শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম

সজনে পাতা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে উপস্থিত ভিটামিন C, ভিটামিন E, এবং অন্যান্য অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদানগুলো শরীরকে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি শরীরের সেলের ক্ষতিরোধেও সহায়তা করে এবং শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

সজনে পাতায় থাকা কিছু উপাদান রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সজনে পাতা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরের রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।

৬. হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি

সজনে পাতা পেটের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এটি হজম বৃদ্ধি করতে সহায়ক এবং কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস ও পেটের অন্যান্য সমস্যাগুলোর উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সজনে পাতা প্রাকৃতিকভাবে ফাইবারে সমৃদ্ধ, যা পেটের পরিপাক প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এটি খাবারের পরিপাক বাড়ায় এবং পেটের অস্বস্তি দূর করতে সহায়ক।

৭. ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য

সজনে পাতা ত্বক এবং চুলের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এর ভিটামিন C ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং ফ্রি রেডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এটি ত্বকে অ্যান্টি-এজিং প্রভাব তৈরি করে এবং ত্বককে স্বাস্থ্যবান রাখে। চুলের স্বাস্থ্যেও সজনে পাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি চুলের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে এবং চুল পড়া কমাতে সহায়ক।

৮. অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ

সজনে পাতা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণে সমৃদ্ধ। এটি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস বা স্নায়ুব্যথার মতো রোগ থেকে নিরাপদ রাখে। সজনে পাতার অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রোপার্টি প্রদাহজনিত ব্যথা কমানোর ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর।

প্রতি ১০০ গ্রাম শজনে পাতায় রয়েছে-

  • স্নেহ ১.৪০ গ্রাম
  • সোডিয়াম ১৯ মিলিগ্রাম
  • শর্করা ৮.২৮ গ্রাম
  • লৌহ ৪.০০ মিলিগ্রাম
  • ম্যাগনেশিয়াম ১৪৭ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন সি ৫১.৭ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন এ প্রায় ৩৭৮ মাইক্রোগ্রাম
  • ফাইবার ২.০ গ্রাম
  • প্রোটিন ৯.৪০ g
  • ক্যালসিয়াম ১৮৫ মিলিগ্রাম

শজনে পাতার আরো অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে যেমন-

  • শজনে পাতা হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোন বাড়াতে সাহায্য করে।
  • শরীরের বিভিন্ন ব্যথা দূর করার ক্ষেত্রেও সজনে পাতা খাওয়া হয়ে থাকে।
  • পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতেও এই পাতা উপকার করে থাকে। যেমন খাবার সহজে হজম না হওয়া, পেটে অতিরিক্ত গ্যাস জমা, বুকজ্বালা ইত্যাদি সমস্যা কমাতে সজনে পাতার ব্যবহার অনন্য।
  • হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায় এই পাতার ব্যবহার অনেক। শজনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে, যা দাঁত ও হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।
  • শজনে পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ, যা চোখ ভালো রাখতে এবং চোখের সকল সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

শজনে পাতা খাওয়ার নিয়ম

  • যেহুতো শজনে পাতা একধরনের সবজি তাই এটি বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যেতে পারে-
  • এই সবজিকে অন্যান্য শাকের মতো ভেজে খাওয়া যায় বা সেদ্ধ করে ভর্তা হিসেবও খাওয়া যায়। কিন্তু রান্না করলে আবার এই সবজির ভিটামিন সি অনেকাংশে কমে যায়।
  • এই পাতাকে প্রাকৃতিকভাবে রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে খাওয়া যেতে পারে, এই পদ্ধতি সবথেকে বেশি প্রচলিত। আবার ব্লেন্ড করে জুস হিসেবেও খাওয়া যায়।
  • এই সবজিকে গুড়া করে চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়।

সতর্কতা

  • শজনে পাতার অনেক উপকারিতা থাকার সত্তেও এটি অতিরিক্ত গ্রহণ করার ফলে সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা।
  • এটি অতিরিক্ত সেবনের ফলে বমি বমি ভাব হতে পারে, পেটের সমস্যা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত না খেয়ে একদিন পর পর বা একটানা ১০-১৫ দিন খাওয়ার পর কিছুদিন বিরত থাকতে হবে।
  • যাদের ব্লাড প্রেসার রয়েছে এবং নিয়মিত ঔষধ খেতে হয় তাদের শজনে পাতার গুঁড়া বা রস খেতে থাকলে ব্লাড প্রেসার কমে যেতে পারে।
  • শজনে পাতার সাথে থাকা ডালগুলোতে ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর।

কারা শজনে পাতা খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবেন

  • গর্ভাবস্থায় শজনে পাতা খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে।
  • ডায়াবেটিস রুগি যারা আছেন তাদের জন্যও এটি ঝুকিপূর্ণ হতে পারে তাই খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *