মিষ্টি জাতীয় খাবার পছন্দ করেন না এমন মানুষ নেই বললেই চল। মিষ্টি দেখলেই আপনার জ্বিবে জল আসে। কোনভাবেই নিজেকে সামলাতে পারেন না। আসলে চিনি আমদের একধরনের আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। চিনির ক্ষতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিজ্ঞানিরা নানা তথ্য দিয়ে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন, তবুও আমরা এর আসক্তি থেকে রেহাই পাচ্ছিনা। প্রাগৈতিহাসিককালে চিনি নামে কোন কিছু ছিলো না, তবে মধু আর মিষ্টি ফল ছিল। কিন্তু আজকার চিনি যেনো আমাদের নিত্য দিনের সাথী। কিন্তু আমরা জানিনা এই চিনি আমদের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর।
সাদা চিনি বা রিফাইন্ড সুগারের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের শরীরের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। এটি কোন প্রকার প্রাকৃতিক উপাদান নয়, বরং এক প্রকার প্রক্রিয়াজাত খাবার যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সাদা চিনিকে বলা সাদা বিষ, যা দ্রুত রক্তে মিশে মস্তিকে প্রবেশ করে। চিনির ভয়াবহতা সম্পর্কে অধ্যাপক তানিয়া ফেরদৌসী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। চলুন দেখে আসা যাক চিনিকে কেনো সাদা বিষ বলা হয়ে থাকে।
১. ওজন বৃদ্ধি এবং মোটা হওয়া
সাদা চিনি খাওয়ার মূল সমস্যা হলো এটি শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরি যোগ করে। চিনি ত্বকে শোষিত হয়ে ফ্যাট হিসেবে জমে যায়, যার ফলে ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে, যাদের অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার অভ্যাস আছে কিন্তু ব্যায়াম করার অভ্যাস নেই, তখন সেই অতিরিক্ত ক্যালরি শরীরে জমে গিয়ে মেদ বৃদ্ধি করে যার ফলে ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বেড়ে যায়। অতিরিক্ত মেদ জমার ফলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং বিভিন্ন হরমোনজনিত সমস্যা।
২. হৃদরোগের ঝুঁকি
সাদা চিনি খাওয়ার কারণে শরীরে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড এবং খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়। এটি হৃদপিণ্ডের জন্য বিড়াট এক সমস্যা, কারণ অতিরিক্ত চিনি হৃদপিণ্ডের কাজের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি খান, তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেশি।
৩. ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিসের মূল কারণ অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করা। সাদা চিনি রক্তে দ্রুত গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়, যা শরীরের ইনসুলিনের কাজকে ব্যাহত করে। দীর্ঘ সময় ধরে বেশি চিনি খাওয়া ইনসুলিন প্রতিরোধের সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলস্বরূপ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসের ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়। ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধুমাত্র অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া এবং ব্যায়াম না করা। এই রোগ যে শুধু চিনি খাওয়ার কারণেই হয় বিষয়টি তা নয়, বরং পর্যাপ্ত পরিশ্রমের অভাবেও এই রোগ হয়।
৪. দাঁতের ক্ষয়
চিনি খেলে মুখে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে, যা দাঁতের এনামেল নষ্ট করে দেয় এবং দ্রুত দাঁত ক্ষয় হয়ে যায়। মুখে বেশি পরিমাণে চিনি/মিষ্টি লেগে থাকলে ব্যাকটেরিয়া দাঁতের ক্ষয় বা ক্যাভিটির সৃষ্টি করে। এই ব্যাকটেরিয়া দাঁত তো ক্ষয় করেই এবং দাঁতের স্বাস্থ্যও নষ্ট করে দেয়, যার ফলে পরবর্তীতে দাঁত তুলে ফেলতে হয়।
৫. ত্বকের সমস্যা
অতিরিক্ত চিনি ত্বকের জন্যও ক্ষতিকর। এটি ত্বকের অভ্যন্তরে এমন এক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে যার নাম গ্লাইকাশন (glycation), যা কোলাজেন এবং ইলাস্টিন নামক ত্বকের প্রোটিনগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। এর ফলে ত্বকে শীঘ্রই বয়সের ছাপ দেখা দেয় এবং বয়সের আগেই বলিরেখা ও শুষ্কতা দেখা যায়। তাছাড়া, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কারণে ব্রণ বা অ্যাকনে জাতীয় সমস্যা থাকলে আরও বেড়ে যেতে পারে।
৬. পেটের সমস্যা
সাদা চিনি খাওয়ার ফলে পেটে গ্যাস, অম্বল এবং হজমের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এটা শরীরের পিত্তথলির কাজকে ব্যাহত করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে। এতে পেট ফোলা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
৭. মানসিক স্বাস্থ্য
চিনির প্রভাব শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়, যা মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। এতে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং অবসাদ সৃষ্টি হতে পারে।
৮. লিভার ও কিডনি ক্ষতি
অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে লিভারের চারপাশে অতিরিক্ত চর্বির স্তর তৈরি হয়, ফলে কিডনির উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে, উচ্চ ফ্রুকটোজ (ফলের চিনি) পরিমাণ শরীরে লিভার ডিজিজ সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী চিনি খাওয়ার কারণে কিডনির কার্যক্ষমতা দিন দিন কমে যেতে পারে।
৯. ক্যান্সারের ঝুকি বাড়ায়
যারা অলরেডি ক্যান্সারে আক্রান্ত তাদের জন্য চিনি এক ধরনের বিষের মত কাজ করে। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে ক্যান্সার আক্রাক্ত ব্যক্তির আয়ু কমে যায়। এছাড়া যাদের ক্যান্সার এখনো হয়নি তারা অবশ্যই চিনি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন কারণ চিনি ক্যান্সারের ঝুকি বাড়ায়।


