বিশ্বের বিখ্যাত তিনটি হ্রদ বা লেক

হ্রদ বা লেক হল প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হওয়া বড় আকারের জলাশয়, যার চারদিক থেকে স্থল দ্বারা বেষ্টিত থাকে। হ্রদ সাধারণত নদী বা সমুদ্রের সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকে না এবং হ্রদের পানি স্থির থাকে। হ্রদের গভীরতা ও আয়তন বিভিন্ন হতে পারে। কিছু হ্রদ মিষ্টি পানির হয় আবার কিছু হ্রদ লবণাক্ত পানিরও হয়।

হ্রদ বিভিন্ন কারণে গঠিত হতে পারে, যেমন:

  • বরফ গলিত পানি জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়।
  • নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি হয়েও হ্রদের সৃষ্টি হয়।
  • ভূমিধ্বসের কারণে।
  • আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে।

হ্রদ আমাদের জীবনে বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগে। কিছু হ্রদ মাছের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আবার কিছু হ্রদ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে। তাছাড়া হ্রদের পানি সেচের কাজেও ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্রদ হল কাস্পিয়ান সাগর এবং গভীরতম হ্রদ হল বৈকাল হ্রদ। চলুন আজকে আমরা তিনটি অদ্ভুত লেক সম্পর্কে জেনে আসি।

১. লেক বৈকাল, রাশিয়া:

“বৈকাল হ্রদ” পৃথিবীর গভীরতম এবং অন্যতম প্রাচীনতম হ্রদ। হ্রদটি রাশিয়ার সাইবেরিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত। এর আয়তন ৩১,৫০০ বর্গকিলোমিটার এবং গভীরতা ১,৬৩৭ মিটার। এই হ্রদটিতে ৩৩৬টি নদী এসে মিশেছে, যার মধ্যে বৃহত্তম নদী হলো সেলেঙ্গা। বৈকাল হ্রদের পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পৃথিবীর বিশুদ্ধ পানির প্রায় ২০% এই হ্রদে রয়েছে। এই হ্রদটি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর আবাসস্থল। ১৯৯৬ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।

বৈকাল হ্রদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • এই হ্রদের বয়স প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছর।
  • পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ পানি রয়েছে বৈকাল হ্রদে।
  • বৈকাল হ্রদে প্রায় ২০০০ এর বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে।
  • এর গভীরতা ১৬৩৭ মিটার।
  • আয়তন ৩১,৫০০ বর্গকিলোমিটার।
  • বৈকাল হ্রদে ৩৩৬টি নদী এসে মিশেছে।
  • এই হ্রদের বৃহত্তম নদী হলো সেলেঙ্গা।
  • এই হ্রদের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে এর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়।
  • বৈকাল হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এছাড়া এই নদীতে সিল মাছও পাওয়া যায়।
  • বৈকাল হ্রদের তীরে অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে।
  • এই হ্রদটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অনেক পরিচিত।

২. লেক ভস্টক, অ্যান্টার্কটিকা:

“লেক ভস্টক” অ্যান্টার্কটিকার পূর্ব-মধ্যভাগে অবস্থিত বিশাল একটি হ্রদ। এই হ্রদটিকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এবং গভীরতম হ্রদগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লেক ভস্টক সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিচে উল্লেখ করা হলো:

আবিষ্কার ও নামকরণ: লেক ভস্টক হ্রদটি সর্বপ্রথম ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন। এই হ্রদের নামকরণ করা হয়েছে নিকটবর্তী রুশ গবেষণা কেন্দ্র “ভস্টক স্টেশন” এর নামে। রুশ ভাষায় “ভস্টক” শব্দের অর্থ “পূর্ব”।

আয়তন: এই হ্রদটির আয়তন প্রায় ১৫,০০০ বর্গকিলোমিটার বা ৫,৮০০ বর্গ মাইল।

গভীরতা: লেক ভস্টকের গভীরতা প্রায় ৯০০ মিটার বা ২,৯৫০ ফুট।

অবস্থান: অ্যান্টার্কটিকার পূর্ব-মধ্যভাগে, ভস্টক স্টেশনের কাছে এই হ্রদটি অবস্থিত। এই হ্রদটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এবং গভীরতম হ্রদগুলির মধ্যে একটি।

বৈশিষ্ট্য: এই হ্রদটি প্রায় ১৪ মিলিয়ন বছর ধরে বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই হ্রদের পানি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জলগুলির মধ্যে একটি।

গুরুত্ব: লেক ভস্টক বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হ্রদ, কারণ এটি পৃথিবীর চরমতম পরিবেশগুলির মধ্যে একটির জ্বলন্ত উদাহরণ। এখানে এমন কিছু জীবাণু থাকতে পারে যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এই হ্রদের গভীরতা এবং পরিবেশ অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, যা বিজ্ঞানীদের ক্রমাগত আকর্ষণ করে।

পরিবেশ ও জলবায়ু: লেক ভস্টকের পানির তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে (-৩° সেলসিয়াস)। এই হ্রদের পানিতে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন দ্রবীভূত আছে, যা অন্যান্য Subglacial lake-এর তুলনায় অনেক বেশি। লেক ভস্টক হ্রদের উপরে বরফের স্তর প্রায় ৪ কিলোমিটার পুরু।

জীববৈচিত্র্য: লেক ভস্টকের পানিতে মাছ বা অন্য কোনো বড় প্রাণী নেই। তবে বিজ্ঞানীরা এই হ্রদের পানিতে বেশ কিছু জীবাণুর সন্ধান পেয়েছেন, যারা চরম ঠান্ডা এবং অন্ধকারে বেঁচে থাকতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই হ্রদে এমন কিছু জীবাণু থাকতে পারে যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

৩. লেক ন্যাট্রন, তাঞ্জানিয়া:

“লেক ন্যাট্রন” উত্তর তানজানিয়ার কেনিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি লবণাক্ত হ্রদ।  মিশরীয়রা তাদের মমি তৈরির কাজে ন্যাট্রন বা সোডিয়াম কার্বনেট ব্যবহার করতো, যেটা এই লেকে প্রচুর পরিমাণেই আছে। এত বেশি যে, এর পিএইচ ১০.৫। যেকারণে অনেক প্রাণি এতে টিকতে পারেনা, এর পানির সংস্পর্শে এলেই শরীরে ক্যালসিয়াম জমে এরা পাথরের মূর্তির মতো হয়ে যায়। মরুভূমি এবং আগ্নেয়গিরি কাছাকাছি হওয়ায় হ্রদটির পানির তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৬০ ডিগ্রি হয়ে থাকে। ন্যাট্রন হ্রদের লবণাক্ততার কারণে সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামক লবণ ভক্ষণকারী এক অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয় এর বেঁচে থাকার জন্য সালোকসংশ্লেষণ প্রয়োজন বিভিন্ন রঞ্জক বহন করে আর এই রঞ্জকের কারণে আকর্ষণীয় রঙের সৃষ্টি হয় তবে এটা ফ্ল্যামিংঙ্গ পাখির খুব সুবিধা জনক প্রজননের জায়গা ।

লেক ন্যাট্রনের কিছু বিশেষত্বের কারণে এটি বিখ্যাত। নিচে এর বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করা হলো:

ভৌগলিক অবস্থান: লেক ন্যাট্রন উত্তর তানজানিয়ার মানিয়ারা অঞ্চলের কাছে অবস্থিত। এটি পূর্ব আফ্রিকান রিফটের একটি অংশ। এর কাছেই রয়েছে বিখ্যাত সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্ক এবং ন্গোরোঙ্গোরো সংরক্ষণ এলাকা।

ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য: লেক ন্যাট্রন একটি অগভীর হ্রদ, এর গভীরতা সাধারণত তিন মিটারের কম। এর আয়তন প্রায় ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ কিলোমিটার প্রস্থ। এই হ্রদের পানি প্রধানত আশেপাশের উষ্ণ প্রস্রবণ এবং ছোট নদী থেকে আসে।

রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য: লেক ন্যাট্রনের পানির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর উচ্চ ক্ষারীয় মাত্রা, যা pH ১০.৫ পর্যন্ত হতে পারে। এর কারণ হলো হ্রদের পানিতে সোডিয়াম কার্বোনেট এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থের আধিক্য। এই কারণে হ্রদের পানি অনেক সময় লাল বা গোলাপি দেখায়।

জীববৈচিত্র্য: লেক ন্যাট্রনে জীবনের অস্তিত্ব বেশ সীমিত, কারণ এর উচ্চ ক্ষারীয় মাত্রা অনেক প্রাণীর জন্য বসবাস করা কঠিন। তবে কিছু বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল এখানে জন্মায়, যা ফ্লেমিঙ্গো পাখির খাদ্য হিসেবে কাজ করে। এই হ্রদটি লেসার ফ্লেমিঙ্গোদের অন্যতম প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র।

বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য: লেক ন্যাট্রনের পানি এতটাই ক্ষারীয় যে কোনো প্রাণী এতে পড়লে তার দেহ দ্রুত ক্যালসিয়াম কার্বোনেটে পরিণত হয়ে যায়, অনেকটা মমির মতো। তবে এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে হয় এবং এর জন্য যথেষ্ট সময় লাগে।

পর্যটন: লেক ন্যাট্রন তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর এবং বিভিন্ন বন্যপ্রাণীও দেখা যায়। তবে হ্রদের পানিতে নামা বা এর কাছাকাছি যাওয়া বেশ বিপজ্জনক।

সংরক্ষণ: লেক ন্যাট্রনের পরিবেশ খুবই সংবেদনশীল। এর পানির রাসায়নিক উপাদান এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা জরুরি। বর্তমানে এর আশেপাশের এলাকা সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *