আজকে আমরা জানতে যাব পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের অধুনা ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত খ্যাতিনামা মহাবিহার। এটি বিহারের রাজধানী পাটনা শহরের ৯৫ কিলোমিটার (৫৯ মাইল) দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউনেস্কো ২০১৬ সালে তার ৪০ তম অধিবেশনে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে ঐতিহ্যবাহী স্থান বলে ঘোষণা করেছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বে ২০ নভেম্বর ২০১০ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটি প্রাচীন মগধের বর্তমান বিহার এবং বাংলার কিছু অংশ ভারতের উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল।
নালন্দা শব্দটির নালোম (পদ্ম) বা দা নালদা থেকে হয়েছে। নালন্দা শব্দের অর্থ জ্ঞান বা জানার আগ্রহ। যতদূর জানা যায়, শক্রাদিত্য নামে একজন রাজা, এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্ত (৪১৪ থেকে ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ) বর্তমান বিহারের নালন্দা জেলায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি একটি বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র। নালন্দা বিদ্যালয় প্রাচীন ভারত তথা এশিয়ার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা দীর্ঘকাল ধরে খ্যাতি অর্জন করে আসছে। গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্ত নালন্দের একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন বলে হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছেন। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং এখানে পড়াশোনা করেছেন।
ইং শিং ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আসেন। এর দৈর্ঘ্য ৮০০ ফুট (২৪০ মিটার প্রস্থ ১৬০০ ফুট (৪৯০ মিটার) এলাকা ১২ হেক্টর জায়গা জুড়ে। ধর্মপালের মৃত্যুর পর মহাস্থবির শীলভদ্র (চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং এর শিক্ষক) নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম আচার্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তারপরে হন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ ইয়ে। ২০০০ শিক্ষক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ হাজার ছাত্রকে শিক্ষাদান করতেন, শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নার্গাজুন (মহাযান দার্শনিক) দিনাগা (ভারতে যুক্তিবিদ্যা একজন বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠাতা) ধর্মপাল (বাংলা অঞ্চলের পাল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট)।
পরিচালনা ব্যবস্থা:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অবনৈতিক আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দানে এ প্রতিষ্ঠানের খরচ চলত বহু ছাত্র। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে আসতো কিন্তু এখানে ভর্তি হওয়ার সহজ ছিল না, প্রতিটি ছাত্রকে প্রবেশিকা শিক্ষা শেষ করে এখানে ভর্তি হতে হত। পরীক্ষাও ছিল খুব কঠিন, পরীক্ষার পর একাধিক্রমে ৭/৮ বছর এখানে পড়াশোনা করতে হতো।
পঠন পাঠন:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১৫ টি বিষয়ে পড়াশোনা হত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বেদ, বৌদ্ধ দর্শন, ব্যাকরণ, নীতি শাস্ত্র, জ্যোতিষ শাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, পালি, সাহিত্য, গণিত শাস্ত্র, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস সবগুলো বিষয়ে ছাত্রদের চর্চা করতে হতো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল বিশাল গ্রন্থাগার। এর তিনটি ভাগ ছিল, যথা : রত্ন রঞ্জক, রত্ন দধি ও রত্ন সাগর। গ্রন্থাকারে বহু পুঁথিপত্র ও আকর গ্রন্থ থাকতো।
হর্ষবর্ধনের আমলে নালন্দা:
উল্লেখ আছে যে, হর্ষবর্ধনের আমলে নালন্দা খ্যাতির শিকড়ে পৌঁছে ছিল। শুধু ভারতে নয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন সমগ্র এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশ-বিদেশের বহু ছাত্র এখানে পড়াশোনা করতে আসতো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০,০০০ ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। এখানে বিখ্যাত পন্ডিতগণ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং শিক্ষকগণ ছিলেন জ্ঞানীগুণী ও চরিত্রবান। মেধাবী ছাত্ররা এখানে বিনা পয়সায় পড়াশোনা করতে পারত এমনকি হিউয়েন সাং এর মত পন্ডিতরা নিজে এখানে পড়াশোনা করেছিলেন। তখন নালন্দার অধ্যক্ষ ছিলেন বাঙালি পণ্ডিত শীলভদ্র এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন।
পাল রাজাদের আমলে নালন্দা:
পাল রাজারা ছিলেন শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। শিক্ষা ও সাহিত্যের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় পাল যুগের হারানো খ্যাতি ফিরে পেয়েছিল। পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দেবপালের আমলে সুমাত্রায় শীলভদ্র বংশীয় রাজা বাল পুত্র দেব তার অনুমতি নিয়ে নালন্দা একটি বৌদ্ধ-মঠ প্রতিষ্ঠা করে। দেব পালে প্রয়াসে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ছাত্ররা পড়াশোনা করতে আসতো। চিন, তিব্বত, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসত। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা চলতো। পঠন পাঠানো ছিল চমৎকার। শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ৪০০ বছরেরও বেশি সময় টিকে ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মোট তিনবার ধংস করা হয়। প্রথমে ধ্বংস করা হয় প্রথম মিহির কূলে শাসনামলে হুন দের দ্বারা। এরপর সর্বশেষ (১২০০ থেকে ১৩ শতাব্দে) পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে মহান অভ্যুত্থানের সময় ছিল আক্রমণ এবং বিজয় দ্বারা। এই সময় সংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ল্যান্ডস্কেপদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
১১৯৩ সালে এই যুগে যে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটে এর মধ্যে একটি হল ইখতিয়ার উদ্দিন মোঃ বখতিয়ার খলজি। বৌদ্ধদের প্রতিষ্ঠিত এ প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান নালন্দা কে ধ্বংস করে দেয় আগুন লাগিয়ে। এভাবে নালন্দার পতন ঘটে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো এভাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আংশিক রূপে টিকে আছে। ১৯৫১ সালে নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের কাছে বিহার সরকার প্রাচীন মহাবিহারটির অনুকরণে পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নব নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে এটি একটি পরিগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়।
২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর নালন্দার নিকটবর্তী রাজগিরে ১৫ জন ছাত্র নিয়ে একটি আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষাবর্ষের সূচনা ঘটে। প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্রটির পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়।
নালন্দা পুরাতত্ত্ব সংগ্রহালয় সম্পাদনা:
নালন্দার ধ্বংসাবশেষের কাছে দর্শকদের সুবিধার জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ একটি জাদুঘর পরিচালনা করে। এই জাদুঘরে নালন্দা ও নিকটবর্তী রাজগির থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শিত হয়েছে। তবে ১৩,৪৬৩টি প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে মাত্র ৩৪৯টিই দর্শকরা দেখার সুযোগ পান। এগুলি চারটি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়।
হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল হল সম্পাদনা:
নালন্দায় হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল হল হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল হল হল একটি ইন্দো-চীনা যৌথ উদ্যোগ। চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের সম্মানার্থে এই সভাঘরটি স্থাপন করা হয়েছে। এই সভাঘরে হিউয়েন সাংয়ের মাথার খুলির এক টুকরো হাড় প্রদর্শিত হয়েছে।
নালন্দা মাল্টিমিডিয়া মিউজিয়াম সম্পাদনা:
নালন্দার ধ্বংসাবশেষের কাছে নালন্দা মাল্টিমিডিয়া মিউজিয়াম নামে আরেকটি জাদুঘর বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে। এই জাদুঘরে নালন্দার ইতিহাস ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন ও অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে।


