আর্যদের আদিনিবাস ও ইতিহাস

ইতিহাসে অনেক বিষয় নিয়ে দ্বিমত রয়েছে এর মধ্যে সব থেকে আলোচিত বিষয়টি হচ্ছে আর্যদের বাসভূমি নিয়ে । আর্যদের আদি নিবাস ভারত নাকি বহির্বিশ্বের কোথাও থেকে এসে ভারতে বাস শুরু করেছে এ নিয়ে দ্বিমত প্রাচীনকাল থেকেই শুরু হয়ে এখনো আছে। আজকে এ বিষয় নিয়েই আলোচনা করব ।

সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ধীরে ধীরে একটি জাতি ভারতের ইতিহাসে প্রবেশ করতে থাকে। এরাই আর্য নামে পরিচিত। আর্যদের ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ । বেদের মধ্যে দিয়ে আর্যরা তাদের সংস্কৃতির ছড়িয়ে দেয় ভারতের ইতিহাসে, তাই আর্যরা যে সভ্যতা গড়ে তোলে কালক্রমে তা বৈদিক সভ্যতা নামে পরিচিত। আর্য শব্দের অর্থ বিশ্বস্ত মানুষ বা একই জাতির মানুষ। বেদ অনুসারী বা বেদ রচনাকারি নিজেদের ভারতের প্রাচীন অধিবাসীদের থেকে আলাদা ও উন্নত জাতি বলে মনে করত। তারা ভারতের আদিবাসীদের এই কারণে শত্রু -দাস -দস্যু মনে করত। আর্যদের  উৎস অনুসন্ধানে ১৯ শতকে ইউরোপীয় পণ্ডিত যেমন ১৮৪৫ সালের জে সি পিচার্ট একটি মানব গোষ্ঠীর কথা বলেছেন যারা সংস্কৃতি, জার্মান ,গথিক, প্রভৃতি ভাষাভাষীর মানুষের পূর্বপুরুষ মনে করেন। এই জাতিগোষ্ঠীরা মানুষের স্ক্যানডিনোভিয়া থেকে গঙ্গা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্যদের উৎস নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছেন। যেমন একদল পন্ডিত মনে করেন,  বহির্বিশ্বের কোথাও নয় ভারতেই আর্যদের আদি নিবাস। এ মতের পক্ষে আছেন এফ ই পার্জিটার , মহামোপাধ্যায়, গঙ্গা নাথ ঝাঁ, ডি.  এস. এিবেদ, এল ডি শ্রীকন্ঠ শাস্ত্রী।

গঙ্গা নাথ ঝাঁ এর মতে, “ভারতের উত্তর-পশ্চিমে ব্রহ্মর্ষি দেশই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি।

ডি এস এিবেদ এর মতে, মুলতানের দেবিকা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল আর্যদের আদিবাসভূমি ছিল। নীল কষ্ট এর মতে, ভারতের পঞ্চনদ  আর সপ্তসিন্ধু আর্যদের আদি বাসভূমি।

তারা অনেকগুলো যুক্তি স্থাপন করেছেন :

১. বৈদিক সাহিত্যে যে সকল গাছ এবং পশু পাখির উল্লেখ আছে তা ভারতের পাঞ্জাব এবং সপ্তসিন্ধু এইসব সন্নিহিত অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।

২. ভাষা তত্ত্বের দিক থেকে দেখা যায় যে, মূলত ইন্দো ইউরোপের ভাষার সর্বাধিক শব্দ সংস্কৃতে এসেছে অন্য কোন ভাষার নয় ।

৩. পার গিটার মনে করেন, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ভারতে আর্যদের আগমনের কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই বরং উত্তর-পশ্চিম দিক হতে আর্যদের ভারতের বাহিরে চলে যাওয়াটা সম্ভব। ঋগ্বেদের মধ্যে নদীর স্তোএে যে নদী গুলোর নাম উল্লেখ রয়েছে তা গঙ্গা থেকে শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিম হয়ে স্বরসতী নদীতে শেষ হয়েছে এই নদীর স্তোএে থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, আর্যরা পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকেই গিয়েছেন।

৪. আর্যদের মধ্যে যারা দেশ ত্যাগ করেছেন তারা অন্য দেশে বসবাস স্থাপন করেন তারা আদিবাসভূমি অর্থাৎ ভারতের কথা স্মরণ করে থাকেন।

৫. আর্যরা যদি বহিরাগত হত তাহলে তাদের আদিবাসভূমিতে বেদের মতো কোনো গ্রন্থরোচিত হওয়ার কথা ছিল কি?

এসব যুক্তি অবতারণা করে কিছু পন্ডিত দাবি করেন যে, আর্যদের আদিবাসভূমি ছিল ভারত বর্ষ। কিন্তু জন মার্শাল, জি কে ঘোষ প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা উপরিউক্ত যুক্তিগুলোর সমালোচনা করে এবং এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন।

১. আর্য জাতির ভারতে আদি বাসস্থান সম্পর্কে কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

২. ভারত যদি আর্যদের আদি বাসস্থান হতো তাহলে ভারত থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আগে ভারতে আর্য বসতি বিস্তার করতো।

৩. বেদে  যেসব গাছপালা ও পশু পাখির নাম উল্লেখ করা তা থেকে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় না যে, সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। তারা এই অঞ্চলে আসেন এবং প্রথম এমন গাছপালা পশু পাখির সাথে পরিচয় ঘটে এ কারণেই এমন উল্লেখ করেছেন।

৪. নদীর স্তোএ দিয়ে আর্য জাতির উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বাইরে চলে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে ৩৯ টি নদীর নাম উল্লেখিত রয়েছে তার মধ্যে ঋগবেদে ২৫ টি  নদীর নাম উল্লেখ আছে কিন্তু গঙ্গার নাম মাত্র একবার উল্লেখ আছে। যেহেতু আর্যদের এদিক দিয়ে বাসভূমি ছিল তাই গঙ্গার নাম বারবার উল্লেখ করার উচিৎ ছিল কিন্তু তা হয়নি।

৫. সংস্কৃত ভাষার মধ্যে তালব্য বর্ণের প্রাধান্য দেখা যায়। ইউরোপ থেকে ভারতে আগমনের পর  দ্রাবিড় ভাষার এমন হয়েছে ।বৈদিক সাহিত্যের সিংহের নাম উল্লেখ থাকলেও বাঘ ও হাতির কোন উল্লেখ নেই।

এরপর এক দল ঐতিহাসিক মনে করেন বহির্বিশ্ব ছিল ভারতের আদিবাসী নিচে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হলো :

১. ম্যাক ডোলেস টাইলস হার্ট প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা বলেছেন যে ইউরোপই হলো আর্যদের আদিবাসভূমি।

২. ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর সাতটি ভাষার পাঁচটি হলো ইউরোপের। শুধু সংস্কৃত ও পারসিক ভাষা ইউরোপের বাহিরে।

৩. বৈদিক সাহিত্যের ওকে, উইলো , বার্জ ঘোড়া, ষাঁড়, শূকরের প্রভৃতি উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু হাতি, বাঘ, উট এর উল্লেখ নেই।

কেউ কেউ মনে করেন বাড়ির সমাধির তিলক উত্তর মেরু অঞ্চল ছিল আর্যদের আদিবাসভূমি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা মেরু অঞ্চলের শৈত্য প্রবাহের কথা স্মরণ করে এ বক্তব্য খারিজ করেন। আবার কেউ কেউ মনে করে মধ্য এশিয়া ছিল আর্যদের আদিবাসভূমি।

ম্যাক্স শুমারের মতে ইন্দোইউরোপীয়ান ভাষা গোষ্ঠীর একটি দেশ কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ দিক দিয়ে এশিয়া মাইননের মধ্যে দিয়ে গ্রিসে পৌঁছায় এবং তাদের অন্য দল মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিমের পথ ধরে ভারতবর্ষে আসেন। জার্মানি ঐতিহাসিক স্টাইন আর্যদের ভাষাতত্ত্বের উপর গবেষণা করে বলেন, ইন্দোইউরোপের ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ দক্ষিণ রাশিয়ার পাদদেশে কিরগিজ পদভূমিতে বসবাস করত।

অবশেষে বলা যায়, কুতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, আর্যদের আদি বাসস্থান নির্ণয়ের বিষয়টি মুশকিল। তারপরও এত যুক্তি সমালোচনা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বহির্বিশ্বের কোন দেশ থেকে ভারতে আগমন ঘটে এবং পরে এখানে বসতি স্থাপন করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *